কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই তাঁর বই পড়ার নেশা ছিল। পাঠ্যবইয়ের বাইরের বই কিনতেই মো. আব্দুল গণি বেশি টাকা খরচ করতেন। বই পড়ার এই আগ্রহ থেকে রাজশাহীর একটি বইয়ের দোকানের মালিকের সঙ্গে তাঁর সখ্য গড়ে ওঠে। এই সম্পর্কের সূত্রে প্রতি মাসে হাতখরচের টাকা ওই দোকানমালিকের কাছে জমা রাখতেন আব্দুল গণি। পরে প্রয়োজনমতো সেই টাকা নিয়ে খরচ করতেন। আর ইচ্ছেমতো দোকান থেকে বই নিয়ে পড়তেন। জমা টাকার বিপরীতে কিছু মুনাফাও পেতেন।
এভাবে চলে অনেক দিন। একসময় আব্দুল গণির মাথায় ব্যবসার চিন্তা ভর করে। ছাত্রাবস্থাতেই মোবাইল ফোনের একটি ছোট্ট দোকান দেন। এরপর সময় গড়িয়েছে অনেক। বর্তমানে আব্দুল গণি রাজশাহী বিসিক শিল্পনগরে দুটি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিক। এর বাইরে আছে আরও দুটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। তবে তাঁর এই উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার পেছনে ছিল অনেক উত্থান-পতনের কাহিনি।
আব্দুল গণির বাড়ি রাজশাহীর বাঘা উপজেলার আটঘরি গ্রামে। বিসিক শিল্পনগরে প্রতিষ্ঠিত তাঁর প্রতিষ্ঠান দুটি হলো এজি প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজ ও এজি প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রিজ। প্রতিষ্ঠান দুটি প্লাস্টিক পেট বোতল ও পেপার কার্টন তৈরি করে। এর বাইরে বাঘায় রয়েছে নাহার টেলিকম ও নাহার ইলেকট্রনিকস নামে আরও দুটি দোকান। এসব প্রতিষ্ঠানে এখন সব মিলিয়ে প্রায় দেড় শ মানুষ কাজ করেন।
সম্প্রতি আব্দুল গণির সঙ্গে প্রথম আলোর কথা হয়। আলাপে আলাপে তিনি তাঁর উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার গল্প শোনান। তিনি জানান, ১৯৯৫ সালে বইয়ের দোকানের ব্যবসা দেখতে দেখতেই তাঁর মনে হয়েছিল চাকরি না খুঁজে নিজেই মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় হাফিজুল ইসলাম নামের একজন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে একটি মুঠোফোন কিনেছিলেন আব্দুল গণি। দোকানি হিসেবে হাফিজুলের ব্যবহার খুব ভালো লেগে যায় তাঁর। তাই মাঝেমধ্যে ওই দোকানে গিয়ে বসতেন। এরপর একসময় ঘনিষ্ঠ বন্ধু আরিফুজ্জামানকে সঙ্গে নিয়ে বাঘায় একটি মোবাইল ফোনের দোকান দেন। দুজনে মিলে বিনিয়োগ করেন ২০ হাজার টাকা। তাঁদের এই দোকানের জন্য বাকিতে পণ্য সরবরাহ করতেন হাফিজুল ইসলাম। শুধু তা–ই নয়, এই হাফিজুলই একসময় আব্দুল গণিকে ব্যবসার জন্য ব্যাংক থেকে ঋণের ব্যবস্থা করে দেন।
আব্দুল গণি জানান, দোকান দেওয়ার এক বছরের মাথায় ২০০৫ সালে আরিফুজ্জামানের সঙ্গে ব্যবসা ভাগাভাগি হয়ে যায়। তাতে মূলধন–সংকটে পড়েন আব্দুল গণি। বাধ্য হয়ে তাই মায়ের একটি জমি ব্যাংকে বন্ধক রেখে ৩ লাখ টাকা ঋণ নেন। তিনটি মোবাইল অপারেটর কোম্পানির সঙ্গেই ছিল তাঁর ব্যবসা। এর মধ্যে ২০০৮ সালে স্ত্রী সুফিয়া খাতুন আমেরিকার ডিবি লটারি জিতেন। কিন্তু পরে কিছু জটিলতার কারণে তাঁর স্ত্রীর আর আমেরিকা যাওয়া হয়নি। তত দিনে ব্যবসায়ে বড় লোকসান করেন তিনি। তখন একটি মোবাইল অপারেটরের সঙ্গে ব্যবসা করার নতুন সুযোগ পান তিনি। তাতে ভালো মুনাফার দেখা পান। পুঠিয়ার বানেশ্বর ও রাজশাহীর আরডিএ মার্কেটে দুটি শাখা চালু করেন ওই দোকানের।
এরপর ২০১১ সালে একজন শুভাকাঙ্ক্ষী ভিন্ন খাতে ব্যবসা সম্প্রসারণের পরামর্শ দেন। আব্দুল গণিও তখন নতুন ব্যবসার সুযোগ খুঁজছিলেন। তত দিনে রাজশাহী শহরে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন তিনি। নতুন ব্যবসার আগ্রহের কথা শুনে এলাকার এক বড় ভাই জাহাঙ্গীর আলম তাঁকে ঢাকার ‘রাজধানী মাঠা’ কারখানায় নিয়ে যান। আব্দুল গণি বলেন, মাঠা কারখানা দেখতে গিয়ে নজর পড়ে মাঠার বোতলের দিকে। এরপর থেকে বোতলের বাজারের খোঁজখবর নিতে শুরু করি। রাজশাহীতে তখন প্লাস্টিকের বোতল তৈরির কোনো কারখানা ছিল না। তাই ঢাকায় প্লাস্টিক পণ্যের এক মেলায় গিয়ে প্লাস্টিকের বোতলের ব্যবসা সম্পর্কে ধারণা নিই। ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাজশাহী বিসিকে ৩ হাজার বর্গফুটের একটি ঘর ভাড়া নিয়ে কারখানা স্থাপনের কাজ শুরু করেন। কারখানা স্থাপন, যন্ত্রপাতি কেনাসহ ৪০ লাখ টাকা খরচ হয়। ২০১২ সালের ১২ মে ওই কারখানায় উৎপাদন শুরু হয়। নতুন কারখানা চালুর কয়েক মাস যেতে না যেতেই এক সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে চার সপ্তাহ শয্যাশায়ী ছিলেন তিনি।
আব্দুল গণি জানান, শুরুতে বাজার ধরার জন্য বাকিতে পণ্য সরবরাহ করতে হয়েছিল। তাতে দেখা দেয় মূলধন–ঘাটতি। ফলে একসময় কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। আব্দুল গলি বলেন, ‘তখন মনে হয়েছিল সব স্বপ্ন বুঝি শেষ। ঠিক এ সময়ই প্রাইম ব্যাংক বানেশ্বরে নতুন শাখা খোলে। আর ব্যাংক স্বপ্রণোদিত হয়ে ১০ লাখ টাকা ঋণ দেয়। এই ঋণ নিয়েই আবার ঘুরে দাঁড়াই।’
নতুন করে যখন ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করলেন আব্দুল গণি তখন চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ায় বিসিকের কারখানা মালিক কারখানা ছেড়ে দিতে বলেন। সেটি ২০১৪ সালের কথা। বাধ্য হয়ে তখন নিজস্ব কারখানার জন্য জমি কেনেন। তত দিনে অবশ্য বিসিকের কারখানার জমির মালিক তাঁর সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নেন। তখন ওই কারখানার পাশাপাশি নিজের কেনা জমিতে কারখানা সম্প্রসারণ করেন তিনি। পরে রাজশাহীতে তরুণ উদ্যোক্তাদের একটি কর্মশালায় অংশ নেন। সেখান থেকে জানতে পারেন ব্যাংকিং লেনদেন ও ব্যবসার নানা খুঁটিনাটি। সেই জ্ঞান কাজে লাগিয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইডিএলসি থেকে ৪০ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে নতুন একটি মেশিন কেনেন। এর মধ্য দিয়ে এজি প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজ পূর্ণাঙ্গ রূপ পায়।
শুরুতে ঢাকা থেকে বোতল তৈরির টিউব কিনে এনে বোতল তৈরি করতে আব্দুল গণি। নতুন মেশিন কেনার পর নিজেরাই বিদেশ থেকে প্লাস্টিক দানা আমদানি করে বোতল তৈরি শুরু করেন। এরপর আব্দুল গণি দেখলেন পণ্য বাজারজাতকরণের জন্য কার্টনের দরকার। কিন্তু রাজশাহীতে কার্টন তৈরির কোনো কারখানা নেই। পরে ২০১৯ সালে বিসিকে কার্টন তৈরির কারখানা গড়ে তোলেন তিনি। এরপরই আসে করোনার ধাক্কা। এ সময় তিনি ঝুঁকি নিয়ে কারখানা চালু রাখেন। কারখানাতেই কর্মচারীদের সঙ্গনিরোধ বা কোয়ারেন্টিনে রেখে উৎপাদন চালিয়ে যান। তাতে ওই সময় রাজশাহীর কার্টনের পুরো বাজার ধরে ফেলেন। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি আব্দুল গণিকে। অথচ তাঁর বাবা আব্দুল গফুর চেয়েছিলেন ছেলে চাকরি করুক। কিন্তু আব্দুল গণি কখনো চাকরির জন্য কোনো আবেদনই করেননি। ছুটেছেন ব্যবসার পেছনে। দুঃসময়েও থেমে যাননি। তাতেই এখন সফল উদ্যোক্তা আব্দুল গণি।
Leave a Reply